এম কেফায়েত উল্লাহ খান
নারিকেল বিথী কেয়া ঝোপ প্রবাল সমৃদ্ধ বঙ্গোপসারের কপালে টিপ সেন্টমার্টিন দ্বীপ, যা ভালো লাগার এক অপার স্বর্গরাজ্যে আপনাকে জানাই স্বাগতম। রক্তে ঝরা অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ যা দক্ষিন পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত সমুদ্রের বুকে এক কালি সবুজের নাম ‘সেন্টমার্টিন দ্বীপ’। স্থানীয় ভাবে দ্বীপটির প্রচলিত নাম ‘নারিকেল জিনজিরা’। অসংখ্য প্রবাল দ্বারা বেষ্টিত এই দ্বীপটি। দ্বীপের চারদিকে বিস্তৃত বেলাভূমির নিরাপদ কোলাহল মুক্ত, দুষন মুক্ত, প্রাকৃতিক পরিবেশে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পদব্রজে ভ্রমনের আনন্দানুভূতি, মেঘমুক্ত অন্ধকার রাতে অগুনিত তারা মেলা দেখার সৌভাগ্য, শান্ত সাগরে নীল জল রাশিতে “সমুদ্র স্নান”, চাঁদনী রাতে নরম জ্যোৎস্নায় অবগাহন, শুনতে পাওয়া আকাশ, সমুদ্র ও চাঁদের ফিসফিসানি। ঢেউয়ের মাথায় জ্বলন্ত ফসফরাসের আলো অন্ধকার রাতকে আরো মনোরম করে তুলে। স্বর্গদ্বীপটিতে এলে চারদিকে সমুদ্র সফেন। একেবারে কাকচক্ষু স্বচ্ছ, টলটলে পানির সম্ভার। দিনে আকাশের নীল মেখে নীলাভ দরিয়া আর রাতে জোয়ার ধরা উচ্ছ্বাসে রহস্যময় অপ্সরা। চারদিকে পানির বাউন্ডারি, তাই নির্জনতা অপার। সেন্টমার্টন দ্বীপে আসা মানে প্রকৃতিতে নিজেকে সমর্পণ। আবার নিজের মধ্যেই সেই নির্মল আর উচ্ছল প্রকৃতির উদ্দামতাকে ধারণের সুযোগ। বিশাল জলরাশির সামনে দাড়িয়ে পাহাড়ের গায়ে সোনা রং ছাড়ানো সূর্যোদয় এবং হঠাৎ করে সমূদ্রের বুকে সোনার তলাটির টুক করে হারিয়ে যাওয়া যা আপনার মনের ফ্রেমে বন্দী হয়ে থাকবে আজীবন। নানা রঙের পাখির কলাকাকলি আপনার অবসরকে ভরিয়ে তুলবে। ভাটার সময় সমূদ্র তীরে দাড়িয়ে বিচিত্র রং ও আকারের শামুক, ঝিনুক, কড়ি , শৈবাল, কাকড়া, জেলেফিস, প্রবাল ইত্যাদি সৃষ্টির বৈচিত্র্যে অনুভব করার সুযোগ এই দ্বীপটি।
হাজারো প্রকৃতির ভরপুরে দেশের প্রধান আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান সেন্টমার্টিন দ্বীপ। ২৭ শে সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী পর্যটন দিবস। প্রধান আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান হিসেবে এই দ্বীপটিতে কখনও দিবসটি পালন করতে দেখেনি। দিবসটি পালন না করারই কথা। অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত এই দ্বীপের পর্যটন মৌসুম। প্রতিবছর দেখা যায়, দ্বীপে পর্যটন মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই দ্বীপের নানান বিষয় নিয়ে সরকারিভাবে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। যারফলে, কোন বছরেই সঠিক সময়ে পর্যটন মৌসুম শুরু করতে পারেনা পর্যটন ব্যবসায়ীরা। যেখানে নিজের জীবন চলেনা সেখানে দিবসের খবর কে রাখে! এবারেও তার বিপরীত নয়। দ্বীপের পর্যটন মৌসুম নিয়ে চলছে পর্যটন ব্যবসায়ীদের মাঝে নানান জল্পনা কল্পনা। পর্যটকদের রাত্রিযাপন করতে দেওয়া হবে, তিন বছরের জন্য দ্বীপে পর্যটক বন্ধ করা হবে, পর্যটক সীমিত করা হবে, হোটেল রিসোর্ট উচ্ছেদ করা হবে, দ্বীপে লোকজন থাকতে পারবেনা ইত্যাদি এমন সরকারী পরিকল্পনা।
এই দ্বীপে লোকজনের বসবাস প্রায় আড়াইশত বছর। বর্তমানে দ্বীপে প্রায় সাড়ে দশ হাজার লোক বসবাস করে। দ্বীপবাসীর চলমান প্রধান আয়ের উৎস পর্যটন ব্যবসা। যদিও একসময় ফিশিং ছিল। পর্যটন মৌসুমের পাঁচ মাসের ইনকাম নিয়ে পুরো বছর জুড়ে চলে দ্বীপবাসীর জীবনযাপন। তাই তারা পর্যটন মৌসুমের জন্য হাহাকারময় অপেক্ষা করতে হয় প্রতি বছর।
উল্লেখ্য যে, ১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল সেন্টমার্টিন দ্বীপকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করা হলেও স্বাধীনতার পর থেকে ৪৭ বছরে এ পর্যন্ত সরকার দ্বীপে অবকাঠামো নির্মাণসহ অন্যান্য কোন কাজকর্ম সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও পর্যটন উন্নয়নের জন্য পরিকল্পিত মাস্টারপ্ল্যান করেনি। ফলে নীতিমালাহীন দীর্ঘ ২৮ বছরের মধ্যে দ্বীপে লোকসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে ইতিমধ্যে অনুমতিবিহীন ও অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র জায়গায় অনেক অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। নির্মাণ করা হয়েছে সরকারী ও বেসরকারীভাবে বহুতল ভবণ। গড়ে উঠেছে শতাধিক আবাসিক হোটেল রিসোর্ট। যারফলে, নষ্ট হচ্ছে দ্বীপটির অবকাঠামোগত পরিবেশ। সেই সাথে দ্বীপটি পর্যটকদের কাছে দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান হিসাবে স্থান করে নিয়েছে।
এমতবস্থায়, পরিবেশবাদী কোন সংগঠনের পরিকল্পনা ও প্ররোচনা আমলে না নিয়ে, কোন প্রকার উচ্ছেদ-উৎখাত ও পর্যটক বন্ধ বা রাত্রিযাপন বন্ধের নীতিমালায় না গিয়ে, পর্যটন আগমনের পাশাপাশি সরাসরি সরকার কতৃক একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে দ্বীপের মূল সমস্যা ও সম্ভাবনাময় চিহ্নিত করে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে রক্ষা করা একান্ত জরুরী। কেননা, ব্যবসা প্রতিষ্টান কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্টান বন্ধ রেখে যদি অত্র প্রতিষ্টানের সংস্কারের কাজ করা হয়, এতেই ব্যবসা ও পাঠদানে ক্ষতি হয়ে যাবে। ঠিক সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটক বন্ধ করে দ্বীপের মেরামতের কাজ করা হলে দ্বীপের স্থানীয় বাসিন্দা, দ্বীপের হোটেল রিসোর্ট ব্যবসায়ী ও পর্যটন ব্যবসায়ীরা চরম হুমকি ও ক্ষতির সম্মূখীন হবে। এছাড়া পুরো কক্সবাজার ও টেকনাফের পর্যটন ব্যবসা অনেকটাই সেন্টমার্টিন দ্বীপের উপর নির্ভরশীল।
চলমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দ্বীপের প্রধান প্রধান কিছু সমস্যা ও দ্বীপটির সম্ভাবনাময় লক্ষ্য করা যায়। যেমনঃ অবকাঠামো নির্মাণ নীতিমালা, দ্বীপ রক্ষায় চারপাশ টেকসই বেড়িবাধ, শব্দবিহীন নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় সাইক্লোন সেন্টার, জীবন বাঁচাতে সী এম্বোলেন্স, আধুনিকায়ন টেঁকসই জেটিঘাট, পরিকল্পিত বাজারঘাট, খাদ্য গুদাম স্থাপন করা, হাসপাতালের কার্যক্রম স্বয়ংসর্ম্পূন করা, জাতির উন্নয়নে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাচ্ছন্দ্য চলাচলে পাকা রাস্তা, দ্বীপে ইকোপার্ক গঠনে সৌর্ন্দয বৃদ্ধি করণ, প্রানী ও জীব বৈচিত্র্যে গবেষনাগার স্থাপন করা ইত্যাদি।
উপরোক্ত সমস্যাবলীর পরিকল্পিতভাবে সমাধান যদি সঠিক তদারকী ও সুন্দরভাবে দেখবাল করা হয় সেন্টমার্টিন দ্বীপ অনেকটাই পরিবেশ বান্ধব ও পর্যটন বান্ধব হিসেবে গড়ে উঠবে।
সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে-
লেখক ও সম্পাদকঃ এম কেফায়েত উল্লাহ খান।
“জিনজিরা থেকে সেন্টমার্টিন” বই।
ফেসবুকঃ kefayat.saintmartin
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।